লেডি ল্যাজারাস

- সিলভিয়া প্লাথ

আমি তা আবার করেছি। প্রত্যেক
দশ বছরেই একবার
আমি তো তা করি-

এক ধরণের চলমান বিস্ময়, আমার ত্বক
এক নাত্‌সি বাতির ঢাকনার মতই উজ্জ্বল,
আমার ডান পা

একটি কাগজ চাপা দেওয়ার পাথর,
মুখ এক বৈশিষ্ট্যহীন, সূক্ষ্ণ
ইহুদি লিনেন।

রুমালটা সরিয়ে নাও
ও আমার শত্রু।
আমি ভয় দেখাই?-

নাক, চোখের কোটর, আমার দুপাটি দাঁত দিয়ে?
নিঃশ্বাসের টক স্বাদ
এক দিনেই বিলুপ্ত হ’য়ে যাবে।

অবিলম্বে, অবিলম্বেই কবরে
ক্ষয়ে যাওয়া মাংস
আমার ভীষণ আপন হয়ে যাবে

আর আমি এক হাস্যোজ্জ্বল নারী।
মাত্র ত্রিশ বছর বয়স আমার।
এবং বিড়ালেরই মত আমার আরও নয়টা মরণ বাকি।

এবারেরটা তৃতীয়বার।
কি বিশ্রী এভাবে
প্রত্যেক দশককে ধ্বংস করা।

কত সহস্র সহস্র আঁশ।
বাদাম চিবাতে চিবাতে জনতা
হাতপার বাঁধন থেকে ওদের আমার

শরীরকে খুলে ফেলা দেখতে ভিতরে ঢুকে পড়ে-
ক্রমে ক্রমে এক বিকট অঙ্গাবরণ উন্মোচন।
ভদ্রোমহোদয় ও মহিলাগণ

এগুলো আমার হাত
আমারই হাঁটু।
হয়তবা আমি কেবল চামড়া আর হাড়,

তবু, একই অভিন্ন সেই নারী আমি।
প্রথম যখন এটা ঘটেছিলো আমার বয়স ছিলো দশ।
সেটা এক দুর্ঘটনা ছিলো।

দ্বিতীয়বার চেয়েছিলাম
একে চিরস্থায়ী করতে এবং আর কখনো ফিরে না আসতে।
আমি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সে

এক সাগরের ঝিনুকের মত।
তাদের ডাকতে হয়েছিলো বারবার
আর এঁটে থাকা মুক্তার মত আমার শরীর থেকে সব কীট ঠুকরিয়ে তুলে নিতে হয়েছিলো।

আত্মহত্যা
এক শিল্প, অন্য সবকিছুর মত।
আমি তা অসাধারণ দক্ষতায় নিপুণভাবে করে থাকি।

আমি তা এমনভাবে করি যেন নরক বলেই মনে হয়।
আমি তা এমনভাবে করি যেন সত্য বলে মনে হয়।
তোমরা বলতে পার এ আমার সহজাত একটি অভ্যাস।

এক আবদ্ধ ছোট ঘরে এমনটা করা ভীষণ সোজা।
এমন করা এবং সেখানে থাকা সত্যিই ভীষণ সোজা।
কিন্তু এই নাটকীয়

ফিরে আসা উন্মুক্ত দিনের আলোয়
একই জায়গায় একই মুখের মুখোমুখি, সেই একই বর্বর
আনন্দ উল্লাস-

‘কী আশ্চর্য ঘটনা, অলৌকিক একেবারে।’
-আমি এক প্রচন্ড ধাক্কা খাই।
মূল্য ঠিক করা আছে

উত্‌সুক হয়ে আমার ক্ষতচিহ্নের দিকে তাকানোর জন্য, মূল্য ঠিক করা আছে
আমার হৃত্‌পিন্ডের শব্দ শুনবার জন্য-
তা সত্যিই স্পন্দিত হয়।

এবং মূল্য ঠিক করা আছে, এক বিরাট অঙ্কের মূল্য
একটি শব্দ বা একটু স্পর্শের জন্য
অথবা সামান্য রক্ত

কিংবা আমার টুকরো চুল বা কাপড়ের জন্য।
বুঝলে, বুঝলে হে ডাক্তার।
বুঝলে হে শত্রু।

আমি তোমারই মহত্‌ সৃষ্টি,
আমি তোমারই মূল্যবান,
খাঁটি সোনা

যা এক সুতীক্ষ্ণ চিত্‌কারে গলে যায়।
আমি ঘুরে ঘুরে পাক খাই আর পুড়ে যাই।
মনে করোনা তোমার মহান উদ্বেগকে আমি ছোট করে দেখি।

ছাই, ছাই-
খোঁচা দাও আর নাড়া দাও।
মাংস, হাড়, ওখানে কিছুই নেই-

শুধু এক টুকরো সাবান,
বিয়ের আংটি,
দাঁতের সোনার ফিলিং।

হে ঈশ্বর, হে লুসিফার
সাবধান
সাবধান।

ছাই-এর ভিতর থেকে
আমি উঠে আসি আগুনে চুল নিয়ে
আর মানুষকে খাই বাতাসের মত।

[“Lady Lazarus” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি ১৯৬২ সালের ২৩শে থেকে ২৯শে অক্টোবরে লেখা হয়।
‘লেডি ল্যাজারাস’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতায় উল্লেখিত মেয়েটির সাথে কবির অনেক যেন মিল আছে। কবিতার শিরোনাম এসেছে নিউ টেস্টামেন্টের চরিত্র ‘ল্যাজারাস’ থেকে। ল্যাজারাস মারা যায়, তারপর যীশু তাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনেন। কবিতায় যে মেয়েটির কথা বলা হচ্ছে সে বারবার মৃত্যুর চেষ্টা করছে। প্রতি দশ বছরেই একবার এই চেষ্টা। কিন্তু বারবারই সে আবার ফিরে আসছে।

মেয়েটির মানসিক কষ্ট ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ কষ্টের মতই ভয়ঙ্কর । এরকম কথা প্রচলিত আছে যে নাজিরা ‘হলোকস্ট ভিক্টিম’ দের শরীরের অংশ দিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিষ বানাত। সেই ভয়াবহতা যেন মেয়েটির জীবনেও। একইরকম কষ্ট হচ্ছে ওর। ওর শরীরের চামড়া দিয়েও বুঝি নাত্‌সি বাতির ঢাকনা বানানো হচ্ছে, পা থেকে কাগজ চাপা দেওয়ার পাথর।

সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝতে পারে না মেয়েটির অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। মেয়েটি মৃত্যু থেকে ফিরে এলে তারা বাদাম চিবাতে চিবাতে যেন সার্কাস দেখতে আসে। ওরা প্রত্যেকে চায় মেয়েটির একটু কাপড়ের টুকরা, চুল, রক্ত।
জার্মান ডাক্তারকে সম্বোধন করে তাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করছে লেডি ল্যাজারাস। আবারও নাজিদের উদাহরণ উঠে এসেছে। জার্মান ডাক্তাররা অনেক নৃশংস এক্সপেরিমেন্ট করেছে ইহুদিদের নিয়ে। অন্য অর্থেও ডাক্তাররা তার শত্রু। বারবার আত্মহত্যার চেষ্টার পর ফিরিয়ে এনেছে তাকে মৃত্যু থেকে।

নাজিরা গ্যাস চেম্বারে, ক্রিমেটোরিয়ামে জীবন্ত মেরে ফেলেছে ইহুদিদের। লেডি ল্যাজারাসের মনে হচ্ছে তাকেও বুঝি ইহুদিদের সাথে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।

আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুধু পড়ে আছে ছাই। কোন মাংস বা হাড় আর নেই। পড়ে আছে বিয়ের আংটি, দাঁতের সোনার ফিলিং। নাজিরা মানুষদের শরীরের যা অবশিষ্ট পড়ে থাকত, যে ছাই তা দিয়ে সাবান বানাত। লেডি ল্যাজারাসের শরীর থেকেও বুঝি তেমন সাবান বানানো হবে।

কবিতার শেষ অংশে এসে ধীরে ধীরে লেডি ল্যাজারাসের স্বর পালটে যেতে থাকে। কবিতার শুরুতে অনুভূতিহীন মানুষেরা মজা দেখবার জন্য তাকে দেখতে আসত। অসহায় ছিল লেডি ল্যাজারাস। কিন্তু শেষে এসে দেখা যায় যেন মৃত্যুর মাঝ থেকে লেডি ল্যাজারাসের পুনরত্থান হচ্ছে। তবে লাজ্যারাসের মত যীশুর দ্বারা নয়, লেডি ল্যাজারাস নিজের শক্তিতেই আগুনের মাঝ থেকে জীবন্ত হয়ে উঠছে।]

সিলভিয়া প্লাথ


মন্তব্যসমূহ



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বই -
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।